নালন্দা ধ্বংসের সত্য ইতিহাস: বখতিয়ার খিলজি কি সত্যিই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেছিলেন?

Vedayaan Desk
নালন্দা ধ্বংসের সত্য ইতিহাস: বখতিয়ার খিলজি কি সত্যিই দায়ী? | বিস্তারিত বিশ্লেষণ
নালন্দা ধ্বংসস্থলের আর্কিওলজিকাল সার্ভে ফলক

নালন্দায় ASI-এর ফলক: ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজিকে দায়ী করা হয়েছে

ভূমিকা: আধুনিক ভারতের ইতিহাস চর্চা প্রায়শই ব্রিটিশ শাসনকাল থেকে শুরু হয়। প্রাচীন পুরাণগুলিতে ইতিহাসের উপাদান থাকলেও তা উপেক্ষিত। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় গুপ্ত ও পাল যুগে সমৃদ্ধি লাভ করে, কিন্তু তুর্কি আক্রমণে ধ্বংসপ্রাপ্ত বলে ঐতিহাসিকরা দাবি করেন। সতীশ চন্দ্র (২০০৭) লিখেছেন:

"A Khalji officer, Bakhtiyar Khalji... had attacked and destroyed some of the famous Buddhist monasteries of Bihar, Nalanda and Vikramshila..."

কিন্তু ২০০৬ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডি এন ঝা দাবি করেন, বখতিয়ার খিলজি নালন্দা ধ্বংস করেননি। এরপর অরুণ শৌরীর প্রবন্ধ (২০১৪) এবং বিতর্কের জন্ম। এই নিবন্ধে আমরা প্রাথমিক সূত্র বিশ্লেষণ করে সত্য উদঘাটন করব।

মিনহাজ-ই-সিরাজের তবকাত-ই-নাসিরী: মূল সাক্ষ্য

ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার (পিতার নাম বখতিয়ার, নিজের নাম ইখতিয়ার) মগধ ও গৌড় আক্রমণ করেন। মিনহাজ-ই-সিরাজ (জন্ম ১১৯৩) স্বয়ং বাংলায় ২ বছর থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি বখতিয়ারের সৈন্য নিজাম উদ্দীন ও সমসাম উদ্দীনের সাথে সাক্ষাৎ করেন (৬৪১ হিজরি)।

মেজর এইচ জি রেভার্টির অনুবাদ (১৮৭৩):

"...advanced to the gateway of the fortress of Bihar... captured the fortress... the greater number of the inhabitants were Brahmans with shaven heads; they were slain. There were a great number of books... the whole fortress and city was a college, and in the Hindui tongue, they call a college Bihar."

আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার ফারসি থেকে বাংলা অনুবাদ (১৯৮৩):

"দুইশত সশস্ত্র অশ্বারোহী সৈন্যসহ... বিহার দুর্গ... অধিকাংশ অধিবাসী ব্রাহ্মণ... সকলকেই হত্যা করা হয়েছিল।"
মানের থেকে নালন্দা ও বিহার শরীফের দূরত্ব মানচিত্র

মানের → বিহার শরীফ: ৯৫ কিমি | মানের → নালন্দা: ১০৬ কিমি | নালন্দা → বিহার শরীফ: ১২ কিমি

ডি এন ঝা-র দাবি: বিহার = ওদন্তপুরী, নয় নালন্দা

  • ধর্মস্বামী (১২৩৫ খ্রি.) নালন্দায় রাহুলশ্রীভদ্রের সাথে ছিলেন → নালন্দা তখনও চালু।
  • তারানাথ: চিঙ্গলরাজ গণ্ডোলা মন্দির পুনর্নির্মাণ করেন।
  • পাগ সাম জোন জাং: তীর্থিকরা (জৈন?) গ্রন্থাগারে আগুন লাগান, কিন্তু পুঁথি রক্ষা পায়।

ঝা-র সমর্থকরা বলেন: বখতিয়ার ওদন্তপুরী ও বিক্রমশীলা ধ্বংস করেন, নালন্দা নয়।

ধর্মস্বামীর সাক্ষ্য: নালন্দা ইতিমধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত

  • ৭টি চৈত্য + ১৪টি বিহারের অধিকাংশ অব্যবহারযোগ্য (১৪টি আবিষ্কৃত, বাকি ৭টি সম্পূর্ণ ধ্বংস)।
  • মাত্র ২টি বিহার চালু, ৭০ জন ছাত্র (একসময় হাজারো)।
  • আফগানরা (ওদন্তপুরী থেকে) লুঠ করতে আসে, ভিক্ষুরা পালায়।

উপসংহার: বখতিয়ারের মৃত্যুর (১২০৬) ৩০ বছর পরও আক্রমণ চলছে → ধ্বংস ধারাবাহিক।

বিশ্লেষণ: মিনহাজের ‘বিহার’ কি নালন্দা?

পয়েন্টওদন্তপুরীনালন্দা
দুর্গের মতো প্রাচীরনাহ্যাঁ (হিউয়েন সাঙ, ইৎ সিঙ)
অজস্র গ্রন্থকিছুবিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থাগার
ব্রাহ্মণ ছাত্রপ্রধানত বৌদ্ধধর্মনিরপেক্ষ, বেদ-অর্থশাস্ত্র পড়ানো হত
আক্রমণের পর ঘাঁটিহ্যাঁনা (লুঠ করে চলে যায়)

যুক্তি: বখতিয়ার ২ বছর মানেরে ছিলেন, নালন্দার ঐশ্বর্যের খবর রাখতেন। ১২ কিমি দূরে ওদন্তপুরী দখল করলেও নালন্দা এড়ানো অসম্ভব।

তুর্কি-আফগান আক্রমণই নালন্দা ধ্বংসের মূল কারণ

  1. পাগ সাম ও তারানাথ: তুর্কিরা প্রথম ক্ষতি করে।
  2. ধর্মস্বামী: ১২৩৫-এ ১২টি বিহার ধ্বংস।
  3. কোনো হিন্দু রাজা বা ব্রাহ্মণ সাধু ধ্বংস করতে পারেননি।
  4. মিনহাজের বিবরণ নালন্দার সাথে মিলে যায়।

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত: বখতিয়ার খিলজি নালন্দা আক্রমণ করেছিলেন, ধ্বংস সম্পূর্ণ হয় ধারাবাহিক আক্রমণে। ডি এন ঝা-র দাবি প্রাথমিক সূত্রের সাথে সাংঘর্ষিক।

প্রায়শ্চরিত প্রশ্নোত্তর (FAQ)

বখতিয়ার খিলজি কি নালন্দা পুড়িয়েছিলেন?

হ্যাঁ, মিনহাজের সূত্র অনুসারে তিনি ‘বিহার’ দুর্গ আক্রমণ করেন, যা নালন্দা। পোড়ানোর কথা সরাসরি নেই, কিন্তু লুঠ ও হত্যা হয়। পরবর্তী আক্রমণে পোড়ানো হয়।

ধর্মস্বামী নালন্দায় থাকলে ধ্বংস কীভাবে?

১২০৬-এর পরও আক্রমণ চলছিল। ১২৩৫-এ মাত্র ২টি বিহার চালু, বাকি ১২টি ধ্বংস।

তীর্থিকরা কি নালন্দা পোড়ায়?

পাগ সাম-এ বলা হয়েছে, কিন্তু পুঁথি রক্ষা পায়, বিহার অক্ষত। দুই সাধু ধ্বংস করতে পারেননি।

আরও পড়ুন: বিক্রমশীলা ধ্বংসের ইতিহাস | পাল যুগের বৌদ্ধ বিহার

কথোপকথনে যোগ দিন